
সাজেদ রহমান। সিনিয়র সাংবাদিক।।
কলকাতার ভবেন্দ্রনাথ যেভাবে ভীম ভবানী ভবেন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন।
তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। কলকাতার এক ১৪-১৫ বছর বয়সের কিশোর ম্যালেরিয়ায় ভুগে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তার নাম ছিল ভবেন্দ্রমোহন সাহা। সমবয়সী একটি ছেলে তাকে খুব মারধোর করেছিল একবার। অপমানিত ভবেন্দ্রমোহন নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে দৈহিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠল। অতীন্দ্রকৃষ্ণ বসু ওরফে ক্ষুদিবাবুর কাছে গিয়ে শিখতে লাগল কুস্তি। অল্প বয়সেই কয়েকজন নামজাদা পালোয়ানকে কুপোকাত করে সবার নজর কেড়ে নেয়। সেই কিশোরই পরবর্তীকালে পরিচিত হয়েছিলেন ‘ভীম ভবানী’ নামে।
বিশ শতকের শুরুর দিকের কথা। ভবেন্দ্রর যখন ১৯ বছর বয়স, ভারতপ্রসিদ্ধ কুস্তিগীর প্রফেসর রামমূর্তি নাইডু আসেন কলকাতায় খেলা দেখাতে। ভবেন্দ্রমোহনও খেলা দেখতে যান। ভবেন্দ্রর বজ্রকঠিন শরীর দেখে রামমূর্তি অভিভূত। নিজের সার্কাস দলে যোগ দিতে আহ্বান জানালেন। ভবেন্দ্রর বাবা ততদিনে প্রয়াত। মা অনুমতি দেবেন না। তাই এক মাঝরাতে বাড়ি থেকে পালালেন। রামমূর্তিকে গুরুর পদে বরণ করে তাঁর দলের সঙ্গে চললেন রেঙ্গুন। তারপর সিঙ্গাপুর এবং জাভা।
জাভায় এক ওলন্দাজ পালোয়ান কুস্তি লড়তে চাইল রামমূর্তির সঙ্গে। রামমূর্তির অনুমতি নিয়ে তার সঙ্গে কুস্তি লড়তে গেলেন ভবেন্দ্রনাথ। তিন মিনিটের মধ্যে পরাজিত করলেন সেই ওলন্দাজকে। যদিও রামমূর্তির সার্কাস দলে তাঁর বেশদিন থাকা হয়নি। তাঁর প্রতিভা গুরুকে ছাড়িয়ে গেলে দল ছাড়তে হয়। বাংলায় ফিরে এসে সার্কাসে খেলা দেখাতে থাকেন। তারপর প্রফেসর কে. বসাকের হিপোড্রাম সার্কাসে যোগ দিয়ে এশিয়ে ঘুরতে চলে যান। ভবেন্দ্র তখন দু’হাতে দু’টি চলন্ত মোটরগাড়ি থামিয়ে দিতেন। সিমেন্টের পিপের ওপর ৫-৭ জন লোককে বসিয়ে পিপের ধার দাঁতে চেপে শূন্যে ঘোরাতেন। বুকে ৪০ মণ পাথর চাপিয়ে তার ওপর ২০-২৫ জনকে বসিয়ে খেয়াল খাম্বাজ গাইতে বলতেন। দৈহিক শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে জাপানের সম্রাট তাঁকে স্বর্ণপদক ও নগদ ৭৫০ টাকা পুরস্কার দেন।
দেশে ফিরে এসে নানা জায়গায় শক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন ভবেন্দ্রনাথ। ভরতপুরের মহারাজের কথায় তিনি তিনটে চলন্ত মোটরগাড়ি টেনে রাখেন। একটি গাড়িতে মহারাজ বসেছিলেন, অন্য দু’টিতে ইংরেজ রেসিডেন্ট ও রাজমন্ত্রী। গাড়িগুলোর পিছনে দড়ি বাঁধা হল। একটি দড়ি ভবেন্দ্র কোমরে বাঁধলেন, বাকি দু’টি ধরে রইলেন দুই হাতে। গাড়ি চালু হল, কিন্তু এক ইঞ্চিও নড়তে পারল না। বিস্মিত মহারাজা এক হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন ভবেন্দ্রকে।
মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরকে খুশি করতে বুকের ওপর ভবেন্দ্র তুলেছিলেন বুনো হাতি। এই কাণ্ড দেখে বাংলার গভর্নরও হতবাক হয়ে যান। নিউমোনিয়া রোগের কারণে ১৯২২ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ভীম ভবানী। এখন বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে গিয়েছেন ঠিকই, যদিও একসময়ে তিনি ছিলেন বাংলার স্বাস্থ্য-সচেতন যুবকদের রোল মডেল। ভিজিট করুন